কক্সবাজার, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

ভ্যাকসিন পলিটিক্স এবং অর্থনীতি

ইয়াহিয়া নয়ন::

স্বীকার করে নেয়া ভালো করোনাভাইরাস সম্পর্কে এখনো আমরা অনেক কিছু জানি না। এটা নিয়ে কাজ চলছে সারা দুনিয়ায়। গবেষণাগারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। তবে ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস ঘিরে দেশে দেশে তৈরি হয়েছে নানা গুজব। অন্ধ বিশ্বাসের কারণে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন অনেকে।
ভারতে গোমুত্র খাওয়া,গোবর মাখার খবরতো আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশেও করোনার শুরু থেকে নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। করোনাকে অস্বীকার করতে চান অনেকে। কিছু হুজুরতো বলেছিলেন করোনায় কোনো মুসলিম মারা যাবেনা।

‘আমার করোনা হবে না’ এমন কথা বলতে শোনা যায় বহুমানুষকে। গ্রামে করোনা হয় না, বস্তিতে করোনা হয় না, গরিব মানুষের করোনা হয় না এমন নানা থিওরি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে এসবই মিথ্যা। বরং এসব অন্ধ বিশ্বাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছে মানুষ। অনেকে করোনা হওয়ার পরও স্বীকার করছেন না, নিচ্ছেন না চিকিৎসা। তারা হাসপাতালেও আসতে দেরি করছেন। যে কারণে দুর্গতি বাড়ছে। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের অর্ধেকের বেশি গ্রামের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এ তথ্য জানান। তিনি এটাও বলেছেন, এসব রোগী শুরুতে হাসপাতালে আসছেন না। রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর তারা হাসপাতালে আসছেন।

বস্তিতে করোনা হয় না এমন একটি প্রচারণাও ছিল অনেকদিন ধরে। কিন্তু সম্প্রতি আইসিডিডিআর,বি’র এক গবেষণায় এটি ভুল প্রমাণিত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বস্তি ও বস্তিসংলগ্ন এলাকার সোয়া তিন হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করে অধিকাংশের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি পাওয়ার যায়। এর মধ্যে ঢাকায় অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় ৭১ শতাংশের নমুনায় এবং চট্টগ্রামে পাওয়া ৫৫ শতাংশ নমুনায়। এরমানে হলো বস্তিবাসীদের এই অংশ কোনো না কোনো সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন অথবা করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এর ফলে তাদের শরীরে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এটাকে আল্লাহর রহমতই বলবো।
আইসিডিডিআর,বি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. রুবহানা রকীব এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। পরে ঢাকার একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রথমেই বলেছি, প্রচলিত ধারণা ছিল বস্তিতে করোনা ছড়ায়নি। আমরা এই গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করলাম, বস্তিতে করোনা ছড়িয়েছে এবং সেখানে মানুষের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, রোগটি হওয়ার পেছনে কী কী কারণ কাজ করে। আমরা বেশ কিছু তথ্য নিয়েছিলাম। যেমন তাঁদের মধ্যে স্থূলতা আছে কি না, তাদের ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রোগ আছে কি না, হাইপারটেনশনের ওষুধ খান কি না বা কিডনির সমস্যা আছে কি না। আমরা দেখেছি, যাঁদের স্থূলতা, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো ক্রনিক রোগ আছে, তাঁদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ চিত্র হাসপাতালে যেমন দেখা যায়, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও তা দেখেছি। আমরা আরও কিছু তথ্য নিয়েছি। আমরা দেখেছি, যাঁদের ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের বা ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস আছে বা চোখেমুখে হাত দেয়ার অভ্যাস কম আছে, তাদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

এবার আসছি করোনাভাইরাসের টিকার প্রসঙ্গে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের উপরাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে করোনার টিকা উৎপাদনের কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। তিনি ৬ জুলাই তাঁর ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানান।
হুয়ালং ইয়ান লিখেছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যৌথভাবে করোনার টিকা উৎপাদনের জন্য চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এখানকার অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। চীন এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০টি দেশে করোনার টিকা সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সে এক কোটি ডোজের প্রথম চালান চীন হস্তান্তর করতে যাচ্ছে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের উপরাষ্ট্রদূত জানান, ‘উন্নয়নশীল অনেক দেশ করোনার প্রথম ব্যাচ টিকা হিসেবে চীনের টিকা পেয়েছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা, উন্নয়ন ও সহযোগিতার মাধ্যমে টিকা উৎপাদনের জন্য কাজ করছে চীন। একই সঙ্গে চীন অনেক দেশের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দেশে টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালাতে সহায়তা করেছে।’ হুয়ালং ইয়ান লিখেছেন, চীনের তৈরি করোনার টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। ফলে, চীনের টিকা আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছে।

গত মাসে চীনের সিনোভ্যাকের করোনার টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বাংলাদেশে সিনোভ্যাকের স্থানীয় এজেন্ট। ইনসেপ্টার সঙ্গে চীনের প্রতিষ্ঠানটি যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করতে চায়। যদিও সরকার দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর টিকাদান নিশ্চিত করতে সিনোভ্যাকের কাছ থেকেও টিকা কেনার জন্য আলোচনা করছে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মধ্যে চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে দেড় কোটি টিকা কিনতে চুক্তি করেছে। তার মধ্যে ২০ লাখ টিকার প্রথম চালান ঢাকায় এসেছে। এ ছাড়া চীন গত ১২ মে বাংলাদেশকে সিনোফার্মের পাঁচ লাখ টিকা উপহার হিসেবে দেয়। পরে সিনোফার্মের আরও ছয় লাখ টিকা বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দেয় চীন। চীনের সাথে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনা যে চুক্তি হয়েছে তা প্রতি মাসে আসবে ৫০ লাখ ডোজ করে। আসবে সেপ্টেম্বর মাস থেকে।

রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা স্পুটনিক-ভি কিনতে চুক্তি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘এখন শুধু বাংলাদেশ সরকারের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষা। টিকা কেনার প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পর বেশ কিছু বিষয় নিয়ে রুশ সরকারকে সংশোধনী দিয়েছিল বাংলাদেশ। পরে সেসবের সংশোধনী এনে দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি হয়। ফলে রাশিয়া থেকে স্পুটনিক ভি করোনা ভ্যাকসিন পেতে আরও একধাপ এগিয়ে গেল দেশ।’ রাশিয়ার টিকাও বাংলাদেশে উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে।
চীন-রাশিয়ার টিকা দেশে উৎপাদন করে আফগান পাকিস্তান নেপাল শ্রীলংকায় পাঠাবে বাংলাদেশ। সেই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়েছে। আপাতত টিকা গ্রহণ ছাড়া বিশ্ব মহামারী থেকে রক্ষা নেই কারো। তাই সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
দেশের সচেতন নাগরিকদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, এই মহামারীতে আমরা আমাদের শত্রু-মিত্র চিনেছি। অনেক উন্নত দেশ অতিরিক্ত টিকা মজুত করেও আমাদের দেয়নি। অনেক দেশ দেব বলে কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত দেয়নি। ওই সব কথিত উন্নত দেশ আমাদের দেশের মানবাধিকার নিয়ে খুব মাতামাতি করে। আমাদের দেশে দুতিনটা হত্যাকান্ড হলে সেইসব দেশের মিডিয়া বড় শিরোনাম করে। অথচ আমরা দেখি ওইসব দেশে প্রতিদিনই বন্দুক হামলায় মানুষ মরছে। কিছুদেশ করোনার কারণে আমাদের দেশকে রেড সিগনাল করেছে। অথচ আমাদের চেয়ে ভয়াবহ আক্রান্তের দেশকে তা করেনি। এটা আসলে অর্থনৈতিক রাজনীতি। আমাদের ক্ষমতাশীনরা শক্ত অবস্থানে থাকলে এসবের জবাব আমরা একদিন দিতে পারবো। আমাদের মনে রাখতে হবে,বাংলাদেশের অগ্রগতি বিদেশের অনেক দেশই মানতে পারছে না। সবটা মেনেই এগিয়ে যেতে হবে।

পাঠকের মতামত: